NEN এর সুবাদে ছাত্ররা কলেজে শিখছে উদ্যোগের পাঠ
কলেজে কলেজে এখন ই-সেল তৈরি হয়েছে। উদ্যোগের দুনিয়ার সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্ক যাতে তৈরি হয়, বিজনেস বা পড়াশুনোর শেষে নিজের উপার্জন নিজে করতে পারে তার জন্যে কলেজে কলেজে উৎসাহ দেওয়ার কাজটা গত কয়েক বছর ধরে শুরু হয়েছে কলকাতায়। এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন উদ্যোগপতিদের সংস্থা। সব থেকে উল্লেখনীয় কাজ করছে ডক্টর রমেশ ওয়াধানির ফাউন্ডেশন। ন্যাশনাল আন্ত্রেপ্রেনিওরস নেটওয়ার্কের মাধ্যমে গোটা দেশ জুড়ে কলেজ পড়ুয়া তরুণ প্রজন্মের ভিতর উদ্যোগ তৈরির খিদে জাগিয়ে তোলার কাজ করছে। খুব সম্প্রতি বিভিন্ন কলেজে হয়ে গেল এনইএন বা নেন আয়োজিত বিজনেস মডেলের প্রতিযোগিতা। মূলত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ভিতর এবং কলেজগুলির ভিতর এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সেই সুবাদে বিভিন্ন কলেজে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। সব কলেজের কথা এখানে আলোচ্য নয়। তবে দুটি কলেজের ছবি বললেই আপনারা বুঝতে পারবেন রাজ্যের উদ্যোগপতি তৈরির মানচিত্রটা ঠিক কী! এবং ভবিষ্যতটিও আপনারা হয়ত আন্দাজ করতে পারবেন।

যেমন ধরুন সোনারপুরের স্বামী বিবেকানন্দ ইন্সটিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড কম্পিউটার সায়েন্সে রীতিমত স্টার্টআপ মেলা বসিয়েছিলেন ছাত্রছাত্রীরাই। অধিকাংশই ফুড স্টার্টআপ। খাবারের স্টল দিয়েছিলেন। তাছাড়াও ছিল অন্যান্য স্টার্টআপ। কেউ ঘরোয়া পরিষেবা দেওয়ার আইডিয়া নিয়ে কাজ করতে চান। কেউ চান স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম নিয়ে কাজ করতে। কারও মাথায় কিলবিল করছে ফুড ইনোভেশনের নানান আইডিয়া। একটি ছাত্র এসে বলছিলেন তিনি পড়াশুনোর ফাঁকে ফাঁকে ইভেন্ট করেন। তাই সেই কাজটায় আরও কতরকমের কি অভিনবত্ব আনা যেতে পারে তাই নিয়ে তার দারুণ আগ্রহ। লাইট অ্যাকশন ক্যামেরার একটি স্টল ছিল। দামী দামী ক্যামেরা লেন্স ছড়িয়ে লাইটে শেড দিয়ে রীতিমত পেশাদার ফটোগ্রাফির স্টল খুলে বসেছিলেন এক ছাত্র। জিজ্ঞেস করায় দেখিয়ে দিলেন তার রেভেনিউ মডেল। কত টাকা লগ্নি লাগবে কত টাকা কত দিনে তুলতে পারবেন সব হোম-ওয়ার্ক করে আসা দুর্দান্ত প্রাণ চঞ্চল ভবিষ্যতের একেকজন উদ্যোগপতিকে দেখে দারুণ প্রেরণা হল সেদিন।
আমার সঙ্গে ছিলেন সোমেক চৌধুরী। ফুড ব্লগার এবং তিনিও নিজে তরুণ উদ্যোগপতি। হাতে ধরে বুঝিয়ে বলছিলেন কোথায় কতটা গলদ আছে। কীভাবে এগোনো সম্ভব। ব্যবসা ব্যাপারটা আসলে কী, এবং সাহস কতটা দরকার, ঝুঁকি নেওয়ার হিম্মত যে বই পড়ে, সিনেমা দেখে হয় না এগুলো যে ভিতর থেকে নিজেকেই কুড়িয়ে কাচিয়ে জোগাড় করে নিতে হয় এই সব শুনতে শুনতেই আমার চোখের সামনে একটা আলোময় আগামিকাল ভেসে উঠছিল। ওই কলেজের অধ্যাপক অমিতাভ গুপ্ত বলছিলেন এদের মধ্যে অনেকেরই সম্ভাবনা আছে। এরা অনেকদূর এগোবেন। কেননা এই কলেজ থেকেই অমিতাভর উৎসাহে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসেছেন অনেক তরুণ। তাদের অনেকেই এখন উদ্যোগের দুনিয়ায় বেশ পরিচিত নাম।
আরেকটি কলেজের কথা বলব। সেটি বারাসতে। ক্যামেলিয়া স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি। সেখানেও সমান উৎসাহ। এখনও উদ্যোগী হয়ে ওঠার মত তৈরি নন ছাত্ররা। কিন্তু উৎসাহে ভাঁটা পড়েনি। নানান রকম উদ্ভাবনী আইডিয়া নিয়ে কথা বলছিলেন এক একজন। ভিড়ের ভিতর থেকে একটি ছাত্র উঠে এলেন এমন একটি যান তৈরি করার স্বপ্ন নিয়ে যা চলবে ডায়নামোতে। এবং জ্বালানী লাগবে না। সৌর-বিদ্যুতকে ব্যবহার করা হবে। অথবা কারাভানের আইডিয়া নিয়ে কথা বলতে চাইছিলেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দুজন ছাত্র। ভাবনায় প্রাখর্য এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভাবনার প্রাবল্য আবেগ এবং উদ্ভাবনের নানান চেতনাই এখানে বেশি গুরুত্ব পূর্ণ। এতটাই উদ্ভাবনী ভাবনা যে একজন তো বলেই বসলেন সিগারেটের ফেলে দেওয়া অবশিষ্টাংশ দিয়ে তিনি তৈরি করতে পারেন রেলের তাকিয়া। বসার সিট। এমনকি সেই ফেলে দেওয়া ফাইবার দিয়েই জীবনের নানান প্রয়োজনীয় সামগ্রী চাইলেই তৈরি করতে পারেন। শুধু দরকার একটু মার্কেট রিসার্চ।
অজ পাড়া গাঁর একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। কয়েক কিলোমিটার পায়ে হেঁটে সেখানে পড়তে আসেন এমন সব ছাত্ররা যেসব উদ্যোগের ভাবনা নিয়ে কথা বলছিলেন তা শুনলে ইলন মাস্কও আবেগাপ্লুত হতেন। আলোচনা সভায় ছাত্রদের উদ্যোগের পাঠ পড়ালেন উদ্যোগপতি ক্যাটআইচ ভ্যালুয়ার্সের কর্ণধার ইন্দ্রনীল আইচ। ছাত্রদের উদ্ভাবনী আইডিয়ার ফসল এবং তৈরি করা সামগ্রী বিক্রির জন্যে কলেজের ভিতরই একটি চিপ স্টোরেরও উদ্বোধন করেন ইন্দ্রনীল। উপস্থিত ছিলেন ওই কলেজেরই এক প্রাক্তন ছাত্র বিশ্বজিত শর্মা। যিনি এখন নিজে উদ্যোগপতি হয়েছেন। shoplevy.com নামের একটি ই-কমার্স সাইট খুলেছেন। তার মারফত নানান পরিষেবা দিয়ে থাকেন। তাঁর উপস্থিতিও ছাত্রদের প্রেরণা যোগাল। এই দুটির কোনওটিই আই আই টি খড়গপুর, আইইএসটি শিবপুর কিংবা সেন্টজেভিয়ার্স বা প্রেসিডেন্সির মত নাম করা ইন্সটিটিউট নয়। কিন্তু উদ্যোগের পরিবেশ তৈরির প্রশ্নে সোনারপুর, বারাসাত, বসিরহাট, বহরমপুর, হরিণঘাটা, কল্যাণী এমনকি প্রত্যন্ত জেলার কলেজগুলিও এখন সমান সজাগ। এখান থেকেই বরং স্বপ্ন দেখা শুরু করতে পারেন আপনি।